পশ্চিমা বিশ্বের পৃষ্টপোষকতায় অনেক মানবধিকার সংগঠন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যারা মানবধিকার রক্ষার দাবিতে অত্যান্ত সোচ্ছার। তারা মূলত পশ্চিমা বিশ্বের তাবেদারী করা, বিভিন্ন সংঘাত এ তাদের মতবাদ তুলে ধরা। তবে তাদের নজরদারী বা খরবদারী বা খবরদারীর প্রকোপ আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশেই বেশী। এর অন্যতম কারন অর্থনৈতিক পর-নির্ভরশীলতা, আতœসমৃদ্ধির অভাব। তাছাড়া কিছুটা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাও এর জন্য দায়ী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ কিছু দেশে শাস্তি হিসাবে মৃত্যূ দন্ডাদেশ বাতিল করা হয়েছে। মনে করা হয় যে মানুষের জীবন তো একটাই। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতে একজন এ বিশ্বে আসে এবং তার ইচ্ছাতে চলে যায়।
অতএব মানুষের বিচারে প্রান কেড়ে নেওয়ার মত চরম শাস্তি দেয়া ঠিক নয়। মানবধিকার রক্ষাকারীদের আর একটি জিনিস বিশেষ করে দায়িত্ব, তাহলো বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার বিরোধীতা করা, কিন্তু সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না যদি না সেখানে তাদের স্বার্থ বিঘিœত হয়। আমাদের দেশে অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে একটি অভিযান সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে হয়েছিল। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় অভিযান চালানোর সময় ক্রশ ফায়ারের নামে হত্যাকান্ড ঘঠেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে এধরনের সন্দেহজনক এবং গ্রহনযোগ্য নয় এরকম ঘঠনা
ঘটা মোটেই বাঞনীয় নয়। রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা কিংবা সুষ্ঠভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অসামজ্ঞসতা এধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা যখন দেখি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুষ্ট বিচার হয়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হলো তখন মানবধিকার লংঘনের প্রশ্ন তোলা হয়। জাতি সংঘের মহা সচিব দুঃখ পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে আরেকজন এশিয় জাতি সংঘের মহাসচিব ছিলেন। তিনি বার্মার উ থান্ট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গনহত্যা চলছিল। এই গনহত্যার কথা পাকিস্তানের বইতে পাওয়া যায়। বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক সাপ্তাহিক দি ইকোনমিষ্ট এর বর্ষসেরা বইগুলোগুলির একটির নাম ঞযব ইষড়ড়ফ ঞবষবমৎধস ঘরীড়হ, করংংবহমবৎ ধহফ ঋড়ৎমড়ঃঃবহ এবহড়পরফব বলা বাহুল্য পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে সংগঠিত গনহত্যার কথা বলা হয়েছে।
কিন্ত সে সময় জাতিসংঘের মহাসচিব এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেন নি। এরপরও আমরা পশ্চিমা বিশ্বের মানবধিকার রক্ষার বিষয়টি নিয়ে এত উদ্ধেগের গুরুত্ব দিতাম যদি দেখা যেত তারা এ ব্যাপারে আন্তরিক এবং কোন পক্ষপাত মূলক আচরন করছেন না করত। সেটাই দেখার বিষয়। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিবাদী নেত্রী অন্ধরুতি রায়ের একটি উক্তি মনে পড়ল। নানা ছলনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানো হয় এবং তারা দেশটি দখল করল। প্রধান অজুহাত ছিল যে ইরাকের তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের কাছে গনবিধংসী অস্ত্রের পাহাড় রয়েছে। পরে দেখা গেল যে কিছুই নেই। তখন যে বক্তব্য আনা হলো, তা হলো ইরাক গনতন্ত্র কায়েমের জন্য ঐ দখল। যদিও ইতিহাসে অনেক নজির রয়েছে যে, বহুগনতন্ত্র হরন কারী সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সাহায্য করেছে। আমরা নিজেরা ভূক্তভোগী। পাকিস্তানের সামরিক শাসক যখন পুর্ব পাকিস্তানে গনহত্যা চালাচ্ছিল যেন গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না আসে। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অন্ধরুতি রায় অত্যান্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি তথ্যবহুল নিবন্ধন লিখেছিলেন। সেখানে একটি বাক্য ছিল উবসড়পৎধপু রং ঃযব ভৎবব ড়িৎষফ যিড়ৎব. ১৯৯০ সালে সোভিয়েত গোষ্টির পতনের পর এখন ইউনিপোলার বিশ্ব। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপ্রতিরোধ্য একক ক্ষমতাধর। তবে সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কিছুটা অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছেন। তাকে সংগ দিচ্ছে চীন এবং ভারত। এটি শুভ লক্ষন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। অপরটি মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যাকে তারা মুক্ত বিশ্ব বলে অভিহিত করে।
অন্ধরতি রায় ব্যাঙ্গাতœক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনাকাংখিত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শুনতে খারাপ লাগলে ও খুবই তাৎপর্য্য বহন করে বাক্যটি। মানবধিকার বক্তব্যটিও কি তথৈবচ। একটু আলোচনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। সাদ্দাম গ্রেফতার হলেন। তিনি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। গ্রেফতারের পর আইন অনুযায়ী যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাকে বন্দি করে রাখার কথা। তাকে গ্রেফতার করার পর তার দাঁত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ। টেলিভিশনের পর্দায় বারবার দাঁত পরীক্ষা দেখানো হলো যেন সাদ্দাম একজন জোকার। তাকে সর্বোত ভাবে হেয় করার জন্য এ দৃশ্য দেখানো হয়। এর পর বিচারের নামে প্রহসন করে তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হল এবং ঈদের দিন ফাঁসি দেওয়া হলো। পশ্চিমাদেশগুলো কি তার মৃত্যু দন্ডাদেশ রহিত করার নূণ্যতম প্রচেষ্টা দেখিয়েছিল । বলা বাহুল্য ইরাক সরকারতো তাদের বদৌলতে ক্ষমতাসীন হয়েছে। মানবধিকার লংঘনের প্রশ্নটি আদৌ কারো মাথায় এলোনা কেন?
লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাসের সাকোজির জন্য নিজের ব্যক্তিগত বিমান দিয়েছিলেন, সারকোজির ইলেকশনের জন্য বিশাল অংকের অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যখন পশ্চিমা স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় তখন লিবিয়ার প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর একটি টু শব্দও করা হয় নি।
অতি সম্প্রতি শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে কমনওয়েলথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বৃটেনের প্রধান মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন খুব জোরে শোরে আওয়াজ তুললেন যে, শ্রীলংকায় তামিল বিদ্রোহের দমনের নামে দারুনভাবে মানবধিকার লংঘিত হয়েছে, তদন্ত করতে হবে, ইত্যাদি। তিনি কয়েক সপ্তাহ পর চীনে আসার পর মানবধিকারের প্রশ্নটি লন্ডনে রেখে এলেন। কেননা এর আগে তিনি তিব্বতীদের আধ্যতিœক গুরু দালাইলামাকে স্বাক্ষাৎ দিয়েছিলেন। এতে চীন ভীষন ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সমস্ত ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করার হুমকি দেয়। বৃটেনের ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। তারা ক্যামেরুনকে জানালেন যে এর ফলে তারা প্রতিযোগীতায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পেরে উঠতে পারবে না। ফলে চীনকে তুষ্ট করার জন্য অন্যতম বৃহৎ বানিজ্য প্রতিনিধিদের নিয়ে সেখানে ভ্রমনে আসেন। মাইনাস মানবধিকার খুব খোস দিলে ডেভিড ক্যামেরনের চীনের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। এদিকে গত ২ বছর চীনের শাসনের প্রতিবাদে ১২০ জন তিব্বতীয় নিজেদের গায়ে আগুন জালিয়ে আতœহুতি দিয়েছেন। এছাড়া বিচিন্নতাবাদী আন্দোলনের অভিযোগে চীনা কর্তৃপক্ষ নয় জন তিব্বতীয়কে দন্ডিত করেছেন।
ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হলো তাকে ধর্মীয় বিধান মতে কবর দেওয়া হলো না। বরঞ্চ উল্লাসের মাধ্যমে তাকে হত্যা করার ঘটনা দেশবাসিকে জানানো হলো। এতে মানবধিকার লংগিত হয় নি। মার্কিন নাগরিকদের বড় ক্ষোভ এবং জ্বালা বিন লাদেনের উপর। তাদের অহমিকায় প্রচন্ড আঘাত হেনেছিল বিন লাদেনের বাহিনী। তৎকালীণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ কয়েক ঘন্টার জন্য গৃহহীন হয়েছিলেন। কেননা লাদেন বাহিনীর আঘাত কোথায় না হানতে পারে এই আশংকা। আতংকিত হয়ে সে দেশের বিমান বাহিনী কয়েক ঘন্টা আকাশে উড়ছিল। এই লাদেন অবশ্য তাদের সৃষ্টি। যাক সে কথা। চালক বিহীন ড্রোন বিমান হামলায় নিরীহ মানুষ মারা গেলে তখন মানবধিকার লংঘন হয় না। চীনে ২০১০ সালে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী লিউ জিয়া বাও, দীর্ঘদিন ধরে জেলে রয়েছেন। তার অপরাধ তিনি শান্তিপ্রিয় রাজনৈতিক সংষ্কারের কথা বলেছিলেন। এখানে মার্কিন সরকার নিশ্চুপ। আবার কোথাও দেখা যায় যে, সরকার কোন নোবেল বিজয়ীর প্রতি কিঞ্চিত বিরুপ আচরন করলে মার্কিন সরকারের ঘুম হারাম হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু ভেতরে অনেক নিম্মস্রোত বইছে। চীন কত বিলিয়ন ডলারের মার্কিন বন্ড কিনেছে সে কথা থাক। প্রতিনিয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের মেয়ররা চীনে এসে ধারনা দিচ্ছেন এখানকার বিনিয়োগ কারীকে আকৃষ্ঠ করার জন্য। ছোট বড় সব পৌর কর্পোরেশন একাজে লিপ্ত। আলাবামা অংগ রাজ্যের ছোট শহর টমাস ভিল। মাত্র ৫ হাজার লোকের বাস। সেখানকার পৌর মেয়র মেলডন ডে চীনে গিয়ে এক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি করেছেন। তিনি তার শহরে কপার টিউব প্রস্তুতের কারখানা করবেন। তিনশত লোকের কর্মসংস্থান হবে। অতএব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট চীনের মানবধিকার লংঘনের বিষয় নিয়ে কথা বলার কোন সুযোগ নাই।
বর্তমানে মায়ানমারে সামরিক জান্তার যোগসাজসে বৌদ্ধরা যে ভাবে মুসলমানদের হত্যা করেছে, তাতে কোন প্রতিবাদ দেখা গেল না মানবধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। পশ্চিমা মিডিয়া গুলো আজ মানবধিকার প্রশ্নে অগোচরে। সেই কাজটি মুসলমান করতে গেলেই মিডিয়া ও মানবধিকার সংগঠনগুলো একট্টা হতো।
তাই এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে পশ্চিমা বিশ্বের মানবধিকার লংঘন নিয়ে কথা বলার ভেতর কতটা আন্তরিক, আর কতটা শঠতা। ইতিপূর্বের ধারাবাহিকতায় দু চারটি ছাড়া বাকি সকল আর্ন্তজাতিক মানবধিকার সংগঠন গুলো তাদের প্রভূ পশ্চিমাদের স্বার্থই সব সময় দেখে থাকে। মানবধিকার সেখানে কোন কথা নয়, শুধু মাত্র কায়েমী স্বার্থের জন্য মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন